বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সময় সংস্কৃতি সমাজে অসামান্য অবদান রেখেছেন। হাজারো বাধার দেয়াল টপকে এনে দিয়েছেন আলো। পৃথিবীর কাছে সাধারণ থেকে তারা হয়ে উঠেছেন অসাধারণ। এমনি একজন অসাধারণ নারী হলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। আজ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুবার্ষিকী । ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এই সেনানী।
জাহানারা ইমাম মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত মা, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সংগঠক। তার নেতৃত্বেই গত শতকের নব্বইয়ের দশকে গড়ে ওঠে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে করা সেই আন্দোলনই নতুনভাবে দেশের মানুষকে জাগিয়ে তোলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে।
মহান এই নারীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বিকেল ৩টায় উপলক্ষে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারের আয়োজন করেছে। এতে আলোচনার বিষয় ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের নারী সমাজের অবদান’।
ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সভাপতিত্ব করবেন নির্মূল কমিটির সভাপতি সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। এতে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান’ বিষয়ে ‘জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতা’ দেবেন কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন।
যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিচারের আওতায় আনার জন্য জাহানার ইমামের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লেখা ডায়েরি থেকে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ তার এক অনন্য সৃষ্টি। ১৯২৯ সালের ৩ মে অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে জাহানারা ইমাম জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বাবা আবদুল আলীর তত্ত্বাবধানে তিনি রক্ষণশীলতার বাইরে এসে আধুনিক শিক্ষা শুরু করেন।
স্বামী প্রকৌশলী শরীফ ইমামও তাকে লেখাপড়ায় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। ১৯৪৫ সালে কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। বিএড পাস করার পর তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে বাংলায় এমএ পাস করেন। তার কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতার মাধ্যমে।
১৯৫২ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। এর পর ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে তিনি আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ১৯৬৬ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৬৮ সালে তা ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছেলে রুমী ও স্বামীকে হারান। মুক্তিযুদ্ধে ছেলে রুমীর আত্মত্যাগ এবং নিজের অবদানের জন্য আখ্যায়িত হন শহীদ জননী হিসেবে। ১৯৯২ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক হন। এ সময় একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের বিচারের দাবিতে গড়ে তোলা হয় গণআদালত। অসুস্থ অবস্থায়ও তিনি একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির কার্যক্রমে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন।
১৯৯৪ সালের ২৬ জুন দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেটের ডেট্রয়েট শহরের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
মহান এই জননীর রচিত উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থ হচ্ছে- অন্য জীবন (১৯৮৫), বীরশ্রেষ্ঠ (১৯৮৫), জীবন মৃত্যু (১৯৮৮), চিরায়ত সাহিত্য (১৯৮৯), বুকের ভিতরে আগুন (১৯৯০), নাটকের অবসান (১৯৯০), দুই মেরু (১৯৯০), নিঃসঙ্গ পাইন (১৯৯০), নয় এ মধুর খেলা (১৯৯০), ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস (১৯৯১) ও প্রবাসের দিনলিপি (১৯৯২)।