এমসি কলেজে ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে গৃহবধূ গণধর্ষণ মামলার অভিযোগ গঠনের তারিখ পিছিয়েছেন আদালত। চ্যাঞ্চল্যকর এ মামলাটি বিচারের নিমিত্তে অভিযোগ (চার্জ) গঠনের তারিখ ছিল রোববার। চার্জশীটে অভিযুক্ত ৮ জনকেই সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে এনে হাজির করা হয় সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহিতুল হকের আদালতে। তবে অভিযোগপত্রের উপর না-রাজি দাখিলের জন্য সময় প্রার্থনা করেন রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী রাশিদা সাঈদা খানম। তিনি আগামী রোববার (১০ জানুয়ারি) ধার্য তারিখে না-রাজি দাখিল করে মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য আবেদন করবেন বলে জানিয়েছেন আদালত সূত্র।
আদালত সূত্র জানায়, আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে জামিন প্রার্থণা করেন মামলার অভিযোগপত্রের আসামি অর্জুন লস্কর। জামিন আবেদন শুনানী শেষে তা না-মঞ্জুর করেন আদালত।
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যারাতে এমসি কলেজের ছাত্রাবাস প্রাঙ্গনে স্বামীকে আটকে প্রাইভেট কারের ভেতর সংঘবদ্ধভাবে গৃববধূ (২৫)-কে পালাক্রমে ধর্ষণ করে ছাত্রলীগের ৬ নেতাকর্মী।
ঘটনার রাতেই নির্যাতিতার স্বামী বাদি হয়ে এসএমপির শাহপরান থানায় ৬ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। পরবর্তীতে ৬ আসামিসহ সন্দেহভাজন আরও ২ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব ও পুলিশ।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল, মিসবাউল ইসলাম রাজন মিয়া, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসু। গ্রেপ্তারের পর তাদের প্রত্যেককে ৫ দিন করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ড শেষে সকলেই দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
গত ৩ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের ৮ নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করে এই মামলার অভিযোগপত্র প্রদান করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহপরান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য।
অভিযোগপত্রে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ও মিসবাউল ইসলাম রাজন মিয়াকে সরাসরি ধর্ষণে সম্পৃক্ত এবং রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুমকে ধর্ষণের সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই আটজনই বর্তমানে কারাগাওে আটক রয়েছেন।
অপরদিকে- ধর্ষনের অভিযোগে দাখিলকৃত মামলাটি গত ৩ ডিসেম্বর নারী ও শিশু নির্যতন দমন ট্রাইব্যুনালে এবং রোববার (২৭ ডিসেম্বর) চাঁদাবাজি ও মারপিটের অভিযোগের মামলাটি সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য বদলী করেন সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিত্বীয় আদালতের বিচারক সাইফুর রহমান। তাছাড়া অস্ত্র আইনের মামলাটির অভিযোগপত্র (চার্জশীট) পর্যালোচনার জন্য সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিত্বীয় আদালতে রাখা হয়েছে বলে জানায় আদালত সূত্র।
আদালত সূত্র জানায়, গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ৮টার দিকে সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের ভেতরে একটি রাস্তায় প্রাইভেট কারের মধ্যেই গৃহবধূকে গণধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় ধর্ষিতার স্বামী বাদী হয়ে এসএমপি’র শাহপরাণ (রহ.) থানায় (জিআর মামলা ১৩১/২০ ইং) দাখিল করেন। আর রাতে কলেজ ছাত্রাবাসে পুলিশ অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেন বন্দুক ও ধারালো অস্ত্র। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ( জি,আর মামলা নং ১৩২/২০ ইং) দাখিল করেন। এর মধ্যে ৩ ডিসেম্বর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) মো. আবুল কাশেমের আদালতে এই চার্জশিট প্রদান করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহপরান থানার ওসি (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য। ওই মামলাগুলোর মধ্যে ধর্ষনের অভিযোগে দাখিলকৃত মামলাটি দু-ভাগে চার্জশীট প্রদান করা হয়। যার একভাগ ( জিআর ১৩১/২০ ইং) ছিল ধর্ষনের অভিযোগপত্র। আর অপরটি ছিল চাঁদাবাজি ও মারপিটের অভিযোগে ( জিআর ১৩১/২০(এ)) মামলাটি।
এর আগে গত ১ অক্টোবর ও ৩ অক্টোবর দুদিনে এ মামলায় গ্রেফতার ৮ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসি সেন্টারের ডিএনএ ল্যাবে নমুনা সংগ্রহের পর পাঠানো হয় ঢাকার ল্যাবে। সেখান থেকে নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন প্রথমে আদালতে এসে পৌঁছায়। পরবর্তীতে এ প্রতিবেদন তদন্ত কর্মকর্তার হাতে এসে পৌছে ২৯ নভেম্বর।
নির্যাতিতার স্বামীর দায়েরকৃত মামলার পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব ও রেঞ্জ পুলিশ অভিযান চালিয়ে মামলার এজাহার নামীয় ৬ জনসহ মোট ৮ জনকে গ্রেফতার করে। পরে গ্রেফতার আটজনকেই ৫ দিন করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ড শেষে তাদেরকে আদালতে হাজির করা হলে তারা সকলেই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। বর্তমানে তারা জেলহাজতে আটক রয়েছেন। এর সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, হাইকোর্টের নিদের্শে গঠিত তদন্ত কমিটি সিলেটের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের হলরুমে গত ৪ অক্টোবর থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত এ ঘটনায় গণশুনানি করে। পরে কমিটির সদস্যরা এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের গণধর্ষণের ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ সাক্ষীদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করে গত ১৬ অক্টোবর ১৭৬ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন হাইকোর্ট বেঞ্চে জমা দেওয়া হয়েছে। যার শুনানি হয় ২০ অক্টোবর। এদিন শুনানি শেষে প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেন হাইকোর্ট বেঞ্চ।
এদিকে গণধর্ষণের এ ঘটনার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে ২৬ অক্টোবর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও কলেজের অধ্যক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তের দোহাই দিয়ে কলেজ কমিটির এ প্রতিবেদনটি সিলগালা করে রাখেন।
এছাড়া গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনায় জড়িত চার আসামির ছাত্রত্ব এবং সনদ বাতিল করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি তাদের স্থায়ীভাবে এমসি কলেজ থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। বহিষ্কৃতরা হলেন, সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, মাহফুজুর রহমান মাসুম ও রবিউল হাসান।
এর আগে ঘটনার কয়েকদিন পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গণধর্ষণের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি এমসি কলেজে তদন্ত করতে আসে। তদন্ত শেষে তারা তাদের প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন।