এই হারের কি ব্যাখ্যা হতে পারে? বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল হক বা তার পক্ষ নিয়ে যিনি যেই ব্যাখ্যাই দিক, দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে সেই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হবে না। যুক্তিযুক্তও হবে না। দ্বিতীয় ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১১৭ রানে গুঁড়িয়ে বাংলাদেশ নিজেদের জয় লক্ষ্যটা ঠিক করেছিল ২৩১ রানের। হাতে সময় ছিল অফুরন্ত, দেড় দিনেরও বেশি। এই লক্ষ্য তাড়া করে জয় ধরতে দরকার ছিল শুধু ধৈর্য, ধৈর্য আর ধৈর্য ধরে ব্যাটিং করা। কিন্তু বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানেরা সেই ধৈর্যের পরীক্ষায় চরম অধৈর্য হয়ে চতুর্থ দিনেই গলায় পড়ল হারের মালা।
২৩১ রানের লক্ষ্য তাড়ায় অধৈর্য স্বাক্ষর রেখে বাংলাদেশ ২১৩ রানেই অল্আউট হয়ে গেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটা জিতে নিয়েছে ১৭ রানে। যে হারের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশকে পেতে হলো হোয়াইটওয়াশ হওয়ার লজ্জাও। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজটা সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতে নিল ২-০ ব্যবধানে। অথচ দুটি টেস্টেই বাংলাদেশের জয়ের পাল্লাই ভারি ছিল। কিন্তু দুটিতেই জিতল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। চট্টগ্রামের প্রথম টেস্টের হারটা তবু মানা যায়। কারণ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলে নিয়েছিল ঐতিহাসিক জয়। অমন ঘটনা টেস্টে খুব বেশি ঘটে না।
কিন্তু মিরপুরের আজকের হার? হ্যাঁ, বাংলাদেশ হয়তো এর আগে কখনোই চতুর্থ ইনিংসে ২৩১ রান তাড়া করে জেতেনি। কিন্তু এবার তো হাতে সময় ছিল পর্যাপ্ত। ব্যাটসম্যানেরা চাইলে রানের কথা ভুলে উইকেট আক্রে পড়ে থাকতে পারতেন। জয় ধরতে দরকারও ছিল সেটাই। কিন্তু বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের টেস্ট ক্রিকেটের এই প্রয়োজনের কথাটা বোঝাবে কে?
তাদের কাছে যখনই বিলাসি শট খেলে আউট হওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়, সবাই সব সময় একই উত্তরই দেন, ‘এটাই আমার খেলার স্টাইল। এভাবে খেলেই আমি রান করি। দলকে জেতাই।’ তামিম, মুশফিক, মুমিনুল, সাকিবরা এমন উত্তর অনেক অনেক বারই দিয়েছেন। এই টেস্টে হয়তো সাকিব ছিলেন না। কিন্তু দলের হারের পর এবার তামিম, মুশফিক, মুমিনুলরা কি ব্যা্খ্যা দেবেন?
আফসোস হয়তো হতো না। কিন্তু তামিম, মুমিনুল, মুশফিক, মিঠুন, লিটন দাসরা প্রত্যেকেই আউট হয়েছেন ভালো শুরুর পর। প্রত্যাশা জাগিয়ে। বাংলাদেশের আউট হওয়া ১০ ব্যাটসম্যানের ৮ জনই ক্যাচ আউট হয়েছেন। মানে শট খেলতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিয়েছেন প্রতিপক্ষ ফিল্ডারদের হাতে। তখনই বেশি বেশি শট খেলার দরকার পড়ে, যখন রান দরকার থাকে বেশি, সময় হাতে থাকে কম। কিন্তু মিরপুরে চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশের সামনে সমীকরণটা ঠিক উল্টো ছিল। আগামী কালের পুরো দিনটিই পড়ে ছিল সামনে। কিন্তু পঞ্চম দিনে ম্যাচ টেনে নিয়ে যাওয়ার ধৈর্য না ধরে শট খেলতে গিয়ে ম্যাচটা শেষ করে দিল চতুর্থ দিনেই!
অথচ লক্ষ্য তাড়ায় বাংলাদেশের শুরুটা হয়েছিল দারুণ। তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার উদ্বোধনী জুটিতেই তুলে ফেলেন ৫৯ রান। জয়ের লক্ষ্যটা নামিয়ে আনেন ১৭২ রানে। হাতে পুরো ১০ উইকেট। মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশ চতুর্থ দিনের চা বিরতিতে স্বস্তি নিয়েই যেতে পারবে। কিন্তু হঠাৎই এক ঝড়ে এলোমেলো হয়ে যায় সেই আশা। ঝড়টা আবার তুলেন অকেশনাল স্পিনার ক্রেইগ ব্রাফেট।
যিনি সচরাচর বোলিংই করেন না। সেই ব্রাফেটই মিনিট কয়েকের ব্যবধানে ফিরিয়ে দেন বাংলাদেশের দুই ওপেনারকে। বিনা উইকেটে ৫৯ থেকে মুহূর্তেই ২ উইকেটে ৭০ রানের দলে পরিণত হয় বাংলাদেশ। একটু পর নাজমুল হোসেন শান্তও ফিরে গেলে বাংলাদেশ চা বিরতিতে যায় ৭৮ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলার অস্বস্তি নিয়ে।
টেস্ট চেতনায় চা বিরতির আগে হারানো এই তিন উইকেটের দায়ই আউট হওয়া তিনজনের। যে শট খেলে তামিম, সৌম্য, নাজমুলরা আউট হয়েছেন, ওই সময়ে অমন খেলা খেলার কোনো দরকারই ছিল না। তবে চা বিরতির পর আবার আশাটা জাগিয়ে তোলার আভাস দেন মুমিনুল ও মুশফিক জুটি। বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা ভরসা মানেন তাদের। কিন্তু সেই ভরসা চুরমার করে দিতেও সময় নেন মুশফিক, মুমিনুলরা। সেট হয়েও আউট হয়েছেন রান-বিলাসি শট খেলে!
একের পর এক টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান ভরসা চুরমার করায় ক্রিকেটপ্রেমীরা শেষ ভরসা গড়ে লিটন দাস ও মেহেদী হাসান মিরাজের উপর। কিন্তু লিটনও দ্রুতই প্রমাণ করেছেন ভরসা করে লাভ নেই! ভরসার প্রতিদান দিতে পারেননি মেহেদী হাসান মিরাজও। তবে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়ার আগে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। চার-ছক্কায় জাগিয়েছিলেন রোমাঞ্চও।
নাঈম হাসান ৯ম ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন আউট হন, বাংলাদেশের রান তখন ১৮৮। জয়ের জন্য তখনো দরকার ৪৩ রান। উইকেটে মিরাজের সঙ্গী আবু জায়েদ। যিনি ব্যাটটা ঠিক মতো ধরতেই জানেন না! এরই মধ্যে আবার ঘটে যায় অতিরিক্ত ‘৩০’ মিনিট খেলার নাটক।
ক্রিকেটে এটা প্রচলিত প্রথা, কোনো দল ৯ উইকেট হারিয়ে ফেললে ওই দিনেই খেলা শেষ করার জন্য আম্পায়াররা দুই দলের অধিনায়কের সম্মতিতে অতিরিক্ত ৩০ মিনিট খেলা চালিয়ে যেতে পারেন। আজ সেটাই করা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের আগে আগে বাংলাদেশ ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলায় দুই দলের অধিনায়ক্রে সম্মতি দুই আম্পায়ার অতিরিক্ত ‘৩০’ মিনিট খেলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শেষ হয়ে যাওয়া টেস্টটাকে পঞ্চম দিনে টেনে নিয়ে যা যেতেই এই সিদ্ধান্ত। সেই সিদ্ধান্ত সফলও হয়নি। অতিরিক্ত ‘৩০’ মিনিটের পুরোটা খেলতেও হয়নি। তার আগেই গুঁড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের ইনিংস। হার এবং হোয়াইটওয়াশ নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশের।
তবে… তবে। শেষ হওয়ার আগে মেহেদী মিরাজ রোমাঞ্চকর একটা প্রদর্শনী দিয়ে গেছেন। অপর প্রান্তে আবু জায়েদ। তাই উপায়ান্তর না দেখে মিরাজ বেছে নেন বিগ হিটিংয়ের পথ। সেই চেষ্টায় অনেকটা সফলও হন তিনি। পরপর দুই ওভারে ২টি ছক্কা এবং ৩টি চার মেরে জয়ের লক্ষ্যটা নামিয়ে আনেন ১৮ রানে। তার ধুমধারাক্কা ব্যাটিংয়ে ক্যারিবীয়দের বুকেও কাঁপন ধরেছিল নিশ্চিত। উত্তেজনাকর রোমাঞ্চ ঠিকরে বেরোচ্ছিল ধারাভাষ্যকারদের কণ্ঠেও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোমাঞ্চটাকে বাংলাদেশের জয়ে রূপ দিতে পারেননি মিরাজ। আউট হয়ে গেছেন ব্যক্তিগত ৩১ রান করে।
এই জয়ের মধ্যদিয়ে একটা ৬৫ বছরের পুরো এক রেকর্ডু ছুঁয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশের ১০টি উইকেটই তুলে নিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্পিনাররা। ক্যারিবীয় স্পিনাররা সর্বশেষ টেস্টের এক ইনিংসের পুরো ১০ উইকেট তুলে নিয়েছে সেই ১৯৫৬ সালে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে। ৬৫ বছর পর মিরপুরে আজ সেই একই কীর্তি গড়লেন ব্রাফেট, কর্নওয়াল, ওয়ারিকানরা। এই স্পিন কীর্তি গড়তে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন রাহকিম কর্নওয়াল। মিরপুর টেস্টের দুই ইনিংস মিলিয়ে তিনি নিয়েছেন ৯ উইকেট। যা তাকে পাইয়ে দিয়েছে ম্যাচ সেরার পুরষ্কার।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ৪০৯ ও ১১৭
বাংলাদেশ : ২৯৬ ও ২১৩
ফল : ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৭ রানে জয়ী।
সিরিজ : ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২-০ ব্যবধানে জয়ী
ম্যাচ সেরা : রাহকিম কর্নওয়াল
সিরিজ সেরা : এনক্রুমাহ বোনার