রবীন্দ্রনাথ বড়ো হয়েছিলেন উচ্চাঙ্গ সংগীতের আবহাওয়ায়, বিশেষ করে ধ্রুপদের চর্চা হতো তাঁদের বাড়িতে। গানের আসর বসতো প্রায় রোজই, আদি ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা অনুষ্ঠানও হতো সপ্তাহে সপ্তাহে। তা ছাড়া, কিছু দিন তিনি গান শিখেওছিলেন ওস্তাদ বিষ্ণু চক্রবর্তীর কাছে। তাঁদের বাড়ির মাইনে-করা ওস্তাদ যদু ভট্টের গানের তিনি ছিলেন বিশেষ ভক্ত। বলা যায়, গানের মধ্যেই মানুষ তিনি, যদিও স্কুলের লেখাপড়ার মতোই ধরা-বাঁধা গানের শিক্ষায় তাঁর মন ছিলো না। যতোটুকু শিখেছিলেন, তাকে নিজের করে নিয়েছিলেন। গানের ব্যাকরণের ধার ধারতেন না। একটা দৃষ্টান্ত দিই।
১৯২৫ সালের বর্ষাকালে তিনি একটি গান রচনা করেছিলেন—‘কোথা যে উধাও হল মোর প্রাণ উদাসী।’ খেয়াল অঙ্গের গান। যে-বিখ্যাত উচ্চাঙ্গ সংগীতটি দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এ গানটি রচনা করেছিলেন, তার সুর ছিলো মিঞাকি মাল্হার অর্থাৎ তানসেনের মল্লার। রবীন্দ্রনাথের গানটি একবার শোনেন এক নাম-করা ওস্তাদ। তিনি মূল গানটির সঙ্গে হুবহু মিল খুঁজে না-পেয়ে হতাশ হলেন। তাই বললেন, এতো মিঞাকি মাল্হার হলো না, এ হলো রবিকি মাল্হার। এটাই রবীন্দ্রনাথের সকল সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য। গানেরও।
তিনি ছিলেন দারুণ সৃজনশীল এবং মৌলিক। তাই তিনি অনুকরণ করলেও তাকে নিজের করে নিতেন। আপন বৈশিষ্ট্য দিয়ে তাকে রাবীন্দ্রিক করে তুলতেন। ১৯০০ সাল পর্যন্ত তিনি বেশ কিছু ওস্তাদী গানের সুরে নিজের কথা বসিয়ে গান রচনা করেছিলেন। এ গানগুলোকে বলে ভাঙা গান। কেবল ওস্তাদী গান কেন, অন্য গানের সুরেও তিনি অনেকগুলো গান লিখেছিলেন। ইংরেজি গানের সুরে যেসব গান লিখেছিলেন, সেসব গানের ইংরেজি চেহারা যদ্দুর সম্ভব মুছে দিয়েছিলেন। তেমনি কীর্তন অথবা বাউল গানের প্রভাবে যেসব গান রচনা করেছিলেন, তাদের মধ্যেও নিজের বৈশিষ্ট্য আরোপ করেছিলেন।
অল্প বয়সে সপ্তসিন্ধুর ওপারে বিলেতের মাটিতে পা রাখলেও, বাড়ির কাছের আরশি-নগরে যাবার সুযোগ হয়নি। জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্ব পাওয়ার পর তাঁর সেই সুযোগ আসে বিলেত থেকে ফিরে আসার প্রায় দশ বছর পরে। ১৮৯০ সালের শেষে তিনি শিলাইদহে যান। সেখানকার অবারিত প্রকৃতির কোলে প্রবেশ করে তিনি একটা ভিন্ন জগতের স্বাদ পেলেন। যে-প্রকৃতির নৈকট্য লাভের জন্যে ছেলেবেলা থেকে তিনি হাপিত্যেশ করেছেন, শিলাইদহে গিয়ে একদিকে তিনি দেখতে পেলেন সেই উন্মুক্ত বিশ্বকে। আর দেখতে পেলেন সাধারণ মানুষকে। তা ছাড়া, পরিচয় হলো লোকসংগীতের সঙ্গে, বিশেষ করে বাউল গানের সঙ্গে। বাউল গানের গভীর প্রভাব পড়েছিলো তাঁর চিন্তা এবং গানের ওপর।
বাউল গান তিনি প্রথমে শুনেছিলেন কলকাতায়, তরুণ বয়সে। ভালো লাগলেও তখন এ গানের প্রভাব পড়েনি তাঁর ওপর। এমন কি, শিলাইদহে বাউলদের সঙ্গে পরিচয় হবার পরপরই তাদের গানের সুর তাঁকে প্রভাবিত করেনি। বাউল সুরে তিনি প্রথম যে-গানটি রচনা করেন, সে গানটি হলো: ওগো, তোমরা সবাই ভালো। এটি লিখেছিলেন শিলাইদহে যাওয়ার দু বছর পরে, ১৮৯২ সালের শেষ দিকে। তবে তাঁর ওপর বাউল গানের সত্যিকার প্রভাব পড়ে ১৯০৫ সালের শেষ দিকে, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু হবার পর। তিনি তখন গোটা বিশেক দেশাত্মবোধক গান রচনা করেন। প্রায় সবগুলোই বাউল সুরে। এর কারণ তিনি অনুভব করেছিলেন যে, পল্লীর সহজ সুর যেমন সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করবে, রাগরাগিণী-ভিত্তিক গান তেমন করবে না। তিনি চেয়েছিলেন গানগুলো যাতে যদ্দুর সম্ভব বেশি লোকের কাছে পৌঁছে যায়।
এই গানগুলোর মধ্যে কয়েকটি ছিলো ভাঙা গান। যেমন, তিনি শিলাইদহে শুনেছিলেন গগন হরকরার বাউল গান ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’। এই গানের সুরে তিনি ১৯০৫ সালে লিখেছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হয়ে যে-গানটি এখন অমরত্বের দাবি করতে পারে। রাজনৈতিক গুরুত্ব ছাড়া, এ গানের সুরও অসাধারণ এবং হৃদয়স্পর্শী।
এমনি ‘হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতালে আমার একলা নিতাই’ থেকে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’; ‘সোনার গৌর ক্যানে কেঁদে এল ও নরহরি’ থেকে ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ ইত্যাদি গান রচনা করেছিলেন। কিন্তু যতো দিন গেছে, ততোই তিনি ভাঙা গানের বন্ধন থেকে সরে গেছেন। বাউলের সুরকে জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর বহু গানে ব্যবহার করেছেন। সর্বত্র হুবহু বাউল গানের সুরে নয়। তিনি নিজেই লিখেছেন যে, তাঁর ‘অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে … জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে।’
একই কথা প্রযোজ্য ইংর্রেজি ফোক সং সম্পর্কে। ১৮৮০-এর দশকে তিনি ইংরেজি ফোক সং-এর অনুকরণে বাল্মীকিপ্রতিভা, কালমৃগয়া এবং মায়ার খেলার জন্যে কয়েকটি গান লিখেছিলেন। পরে ইংরেজি গানের শিক্ষা দিয়ে নিজের গানকে রঙিন করেছিলেন, কিন্তু হুবহু অনুকরণ করেননি। তাঁর গানের বৈশিষ্ট্যই এখানে যে, তিনি রাগরাগিণীগুলোকে বিশুদ্ধ করে পরিবেশন করতে চেষ্টা করেননি, বরং সেগুলোকে তাঁর নিজের মতো করে নিয়েছিলেন।
তাঁর গানের কাঠামো সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য। আগেই বলেছি, তিনি এই কাঠামো নির্মাণ করেছিলেন ধ্রুপদ গানের চার তুক অথবা স্তবকের আদর্শে। তাঁর প্রায় সব গানেই সুর ও বাণীর চারটি স্তবক দেখতে পাই। অ-ধ্রুপদ গানের বেলাতেও। এমন কি, তিনি যখন কীর্তনের সুরে অথবা বাউল গানের সুরে গান রচনা করেছেন, তখন তাতেও কথা ও সুরের চারটি স্তবক লক্ষ করি। এই কাঠামোর গঠন এতো চমৎকার হয়েছিলো যে, বাংলা গানের তো কথাই নেই, হিন্দী গানও এই আদর্শকে মেনে নিয়েছিলো। নজরুল ইসলাম উচ্চাঙ্গ সংগীত এবং গজল গান দিয়ে খুবই প্রভাবিত ছিলেন। তাই তিনি সর্বত্র চার তুকের আদর্শ অনুসরণ করেননি। কিন্তু তাঁর সমসাময়িক তিরিশ ও চল্লিশ দশকের গীতিকারগণ প্রায় অন্ধভাবে চার তুকের আদর্শকে মেনে নিয়েছিলেন। এ কথা সত্য পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের গীতিকারদের সম্পর্কেও।
এর থেকেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ করি, যখন বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে বোম্বাইয়ের দিকে দৃষ্টি দিই। পঙ্কজ মল্লিক তাঁর আত্মজীবনী—‘আমার যুগ আমার গানে’ লিখেছেন যে, হিন্দী হাল্কা গানে চার তুকের ব্যবহার ছিলো না। কিন্তু তিনি বাংলা গানের অনুকরণে তাঁর সুর দেওয়া হিন্দী গানে সফলভাবে চার তুক ব্যবহার করেন। পরে শচীন দেব বর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সলিল চৌধুরীও হিন্দী চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চার তুকের পরিধিকে আরও প্রসারিত করেন।
কিন্তু চার তুককে গানের আদর্শ কাঠামো হিসেবে মেনে নেওয়ায় সবচেয়ে লাভবান হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজে। এই কাঠামো তাঁর গানকে সনেটের মতো একটা সুনির্দিষ্ট আঙ্গিকের বন্ধনে বেঁধেছিলো। ফলে তাঁর গানের বাণীতে দেখা দিয়েছিলো একটা অসাধারণ শৃঙ্খলা ও সংযম। তাঁর কবিতা বিশ্লেষণ করলে কোথাও কোথাও পুনরাবৃত্তি, অতিকথন এবং অসংযম লক্ষ করা যায়। কিন্তু চার তুকের কাঠামো মেনে চলায় তাঁর গান অতিকথনের দোষ থেকে মুক্ত, যদিও একই বিষয়বস্তুর পুনরাবৃত্তি করেছেন বহু গানে। এর সঙ্গে সনেটের কাঠামোর তুলনা করা যেতে পারে। সনেট চোদ্দো পংক্তির কবিতা। প্রথম আট পংক্তিকে বলা হয় অষ্টক, আর শেষের ছ পংক্তিকে ষষ্ঠক। প্রথম চার পংক্তিকে মূল ব্ক্তব্য উপস্থাপিত হয়। দ্বিতীয় চার পংক্তিতে বক্তব্যের বিস্তার। ষষ্ঠকের প্রথম চার পংক্তিতে বক্তব্য অবরোহণের দিকে অগ্রসর হয়। আর শেষ দু পংক্তিতে উপসংহার।
রবীন্দ্রনাথের চার তুকের কাঠামো অনেকটা এ রকম। চার তুকের কাঠামো দিয়ে তিনি বস্তুত বাংলা কাব্যে একটা নতুন ফর্ম অথবা আঙ্গিক নির্মাণ করেছেন। তাঁর গান থেকে একটা দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টা বোঝা সহজ হবে।
মোর পথিকেরে বুঝি এনেছ এবার
মোর করুণ রঙিন পথ।
এসেছে এসেছে অঙ্গনে এসেছে মোর
দুয়ারে লেগেছে রথ।
সে যে সাগরপারের বাণী / মোর পরানে দিয়েছে আনি
তার আঁখির তারায় যেন গান গায় অরণ্যপর্বত।
দুঃখসুখের এপারে ওপারে দোলায় আমার মন –
কেন অকারণ অশ্রুসলিলে ভরে যায় দু নয়ন।
ওগো নিদারুণ পথ জানি জানি / পুন নিয়ে যাবে টানি
তারে চিরদিন মোর যে দিল ভরিয়া যাবে সে স্বপনবৎ।
এখানে গানের স্থায়ী অংশে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলা হয়েছে যে, করুণ রঙিন পথ আমার বাঞ্ছিত পথিককে আমার দুয়ারে নিয়ে এসেছে। অন্তরায় বলা হয়েছে, পথিক আমার পরানে সাগরপারের বাণী নিয়ে এসেছে, আনন্দে তার আঁখির তারায় অরণ্য ও পর্বত গান গাইছে। সঞ্চারীর কোমল সুরে বলা হয়েছে যে, আসন্ন বিদায়ের করুণ সম্ভাবনার কথা। তা ভেবে আমার হৃদয় সুখেদুঃখে আন্দোলিত হচ্ছে। সব শেষে গানের আভোগ অংশে উপসংহার। তাতে বলা হয়েছে, আমার চিরদিনকে যে-পথিক ভরে দিয়েছিলো, নিদারুণ পথ তাকে পুনরায় স্বপ্নের মতো টেনে নিয়ে যাবে। সুতরাং এ গানের বিন্যাসে একটা সূচনা, বিস্তার এবং উপসংহার আছে।
অনেকেই বলেন যে, রবীন্দ্রসংগীতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কথা ও সুরের অসাধারণ মিলন। কথার উপযোগী সুর। কিন্তু কাছ থেকে দেখলে একে আংশিক সত্য বলে মনে হয়। কারণ, একই সুরে তিনি একাধিক গান রচনা করেছেন। কিন্তু সেই গানগুলোর কথার মধ্যে হয়তো তেমন মিল নেই। অথচ তাদের সুর অভিন্ন। এ ক্ষেত্রে কী করে ঢালওভাবে বলা যাবে যে, তাঁর সব গানে কথার উপযোগী সুর দেওয়া হয়েছে? একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। ‘আজি বারি ঝরে ঝরঝর ভরা বাদর রে’ এবং ‘কবে আমি বাহির হলেম তোমারই গান গেয়ে’ এই গান দুটিতে একই সুর দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ—ইমনকল্যাণ। এমন কি, তাদের তালও এক—তেওরা। অথচ তাদের বিষয়ব্স্তু এবং ভাব এক নয়। এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।
বরং বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য গান রচনা করলেও, বেশির ভাগ গানে তিনি সামঞ্জস্যপূর্ণ সুর দিয়েছেন। অন্তত বিরহের গানে মার্চের সুর দেননি। আসলে তাঁর গানের সুর তাঁর আশ্চর্য কথার আড়ালে ঢাকা পড়েছে। তাঁর গান কেবল গান নয়, তাঁর প্রতিটি গান এক-একটা উৎকৃষ্ট কবিতা। শ্রোতা যখন তাঁর গান শোনে, তখন সেই গানের কথা তাকে আবিষ্ট করে। সুরকে আলাদা করে সে আর বিচার করে দেখে না।
তা ছাড়া, তাঁর অধিকাংশ সুরের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, সেগুলো সাদামাটা, অলঙ্কৃত নয়। বিশেষ করে ১৯০০ সালের পর থেকে তাঁর সুরে এই বৈশিষ্ট্য বাড়তে থাকে। এই সময়কার গানে তান কমতে থাকে। গমক, গিটকিরি, কম্পন – সবই কম। বেড়েছিলো হয়তো মীড়ের পরিমাণ। বস্তুত, তাঁর শেষ জীবনের গানে সাংগীতিক উপাদান যে এতো কম যে, তা সহজে ধরা পড়ে না। কথার ঐশ্বর্য সুরের এই শূন্যতাকে ঢেকে রাখে। কিন্তু রেকর্ডে এইসব গানের মিউজিক শুনলে, ধরা যাক গীটারে, সুরের দৈন্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রসংগীতের শ্রেষ্ঠত্ব তার সুর-সম্পদের জন্যে নয়, বরং তার কথার জন্যে, তার ভাবের জন্যে, তার কাব্যের জন্যে। তাই রবীন্দ্রসংগীতের সমঝদারি অথবা প্রশংসা করার জন্যে গানের তালিম নেওয়ার প্রয়োজন করে না। তাঁর বেশির ভাগ গান সকল শ্রোতারই উপযোগ