চাঁদপুর থেকে কুমিল্লাগামী একটি বাসের গত মঙ্গলবারের দৃশ্য। দোয়েল সুপার পরিবহনের ওই বাসে ৪০ যাত্রীর মধ্যে মাস্ক পরিহিত অবস্থায় দেখা গিয়েছে মাত্র তিনজনকে। রাজধানীর বাইরের সব জেলা শহরেই এখন এ দৃশ্য দেখা যায়। শুধু রাজধানীর বাইরে নয়, ঢাকায়ও এ চিত্র এখন নিয়মিত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের গেটে গতকাল গিয়ে দেখা গেল, সেখানে ভিড় করে আছেন চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনরা, তাদের বেশির ভাগেরই মুখে মাস্ক নেই। একই চিত্র হাসপাতালের ভেতরেও। স্বাস্থ্যবিধি না মানা ও অসচেতনতার এমন চিত্র গণপরিবহন, বাজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসেও দেখা যাচ্ছে। মহামারীকালে জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান এ অসচেতনতার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে দেশে সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রির পরিসংখ্যানেও। বাজার বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর বিক্রয় তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে সুরক্ষা সামগ্রীর বিক্রি নেমে এসেছে অর্ধেকে।
দেশে প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখনো থেমে নেই। উপরন্তু আসন্ন শীতে তা আবারো বিপর্যয়কর রূপ নিতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে এ থেকে সুরক্ষা দিতে ব্যবহার্য সামগ্রীর উৎপাদন ও সরবরাহ এখন পর্যাপ্ত। যদিও জনগণের মধ্যে ব্যবহারের প্রবণতা কমে আসায় গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, লিকুইড জীবাণুনাশক, সু কাভার, সুরক্ষা পোশাক ইত্যাদি সুরক্ষা সামগ্রীর বিক্রি কমেছে। একমাত্র মাস্ক কিছু পরিমাণে বিক্রি হলেও তা আগের চেয়ে অনেক কম। অথচ মহামারীর শুরুর দিকে অস্বাভাবিক ক্রয়প্রবণতা ও জনমনে ব্যাপক আতঙ্কের কারণে দেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর সরবরাহে রীতিমতো ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। রীতিমতো লাগামহীন হয়ে উঠেছিল মাস্কের মূল্য।
বাজার বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর তথ্য পর্যালোচনায় জানা যায়, সুরক্ষা সামগ্রীগুলোর মধ্যে জীবাণুনাশক তরল পণ্যের বিক্রি জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুরক্ষা পণ্যের বিক্রি নেমে এসেছে ৬০-৭০ শতাংশে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী প্রস্তুতকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান স্কয়ারের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত প্রান্তিকে রাজধানীর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির জীবাণুনাশক পণ্যের বিক্রি নেমে এসেছে আগের প্রান্তিকের তুলনায় ২০ শতাংশে। রাজধানীর বাইরে এ হার নেমে এসেছে ১০ শতাংশেরও নিচে। প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে শুধু চিকিৎসা সেবার সঙ্গে জড়িতরাই সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয় করছেন।
বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে মাস্ক সরবরাহ করেছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। গত প্রান্তিকে আগের প্রান্তিকের তুলনায় ৩০ শতাংশ কমেছে প্রতিষ্ঠানটির মাস্ক বিক্রি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মহামারীর শুরুর দিকে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হওয়ায় চড়া দামে বিক্রি হয়েছিল সুরক্ষা সামগ্রী। ওই সময় বাজারে প্রচুর নকল সুরক্ষা সামগ্রীর আধিক্যও দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ পদক্ষেপ নিলে বাজারে এসব নকল সুরক্ষা সামগ্রীর সরবরাহ কমতে থাকে। বর্তমানে চিত্র পুরোপুরি উল্টো। এসব সুরক্ষা পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ এখন পর্যাপ্ত। কিন্তু কিছু পরিমাণে মাস্ক বিক্রি হলেও অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী তেমন একটা বিক্রি হচ্ছে না।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা নিয়ে মানুষের কাছে একটা ভুল বার্তা গিয়েছে। এজন্য মানুষ বিষয়টিকে তেমন একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। অথচ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।
এ বিষয়ে দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, মানুষ দেখছে এটা নিয়ে তেমন একটা কথাবার্তা হয় না। প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে ব্রিফিং করত, সেটাও বন্ধ। এতে মানুষ মনে করছে করোনা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
এ অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে আরো জোরালো ভূমিকার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন এ ভাইরাস বিশেষজ্ঞ।
দেশে জীবাণুনাশক বাদে প্রায় সব ধরনের সুরক্ষা সামগ্রী উৎপাদন ও বিপণন করছে পোশাক ব্র্যান্ড ইয়েলো। প্রতিষ্ঠানটির মাস্কের বিক্রি গত দেড় মাসে ৪০-৫০ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির হেড অব রিটেইল অপারেশন হাদী এসএ চৌধুরী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও বিক্রি কমেছে। কেউ যদি দিনে ১০ লাখ মাস্ক চায়, আমরা তা সরবরাহ করতে পারব। আমাদের উৎপাদনের ঘাটতি নেই। আগে রাজধানীর শোরুমগুলো থেকে প্রতিদিন দুই হাজার পিসের বেশি মাস্ক বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হয় হাজারের চেয়ে কিছু বেশি।
তিনি জানান, করোনা সংক্রমণ শুরুর পর দেশে সাধারণ ছুটি চলাকালে অনলাইনে প্রচুর মাস্ক বিক্রি হয়েছিল। রোজার ঈদের পর পর্যন্ত এ বিক্রি অব্যাহত থাকলেও পরে তা ধীরে ধীরে কমে যায়।
রাজধানীর ধানমন্ডি, শাহবাগ, শ্যামলী, বনশ্রী, মহাখালীসহ বিভিন্ন এলাকার ওষুধের দোকান ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে দেখা গিয়েছে, সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে অনেক কম। মাস্কের বিক্রি কিছুটা থাকলেও জীবাণুনাশক দ্রব্য, গ্লাভস, সু কাভার, সুরক্ষা পোশাক বিক্রি হচ্ছে কালেভদ্রে। কলাবাগানে একটি ওষুধের বিপণিবিতানের বিক্রয়কর্মী মো. রফিক জানান, আগের থেকে সুরক্ষা সামগ্রীর সরবরাহ বেশি ও দাম কমলেও বিক্রি হচ্ছে কম। বছরের মাঝামাঝিতে দিনে ১০ থেকে ২০ প্যাকেট মাস্ক এবং শতাধিক হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি হলেও এখন দিনে ১০টিও স্যানিটাইজার বিক্রি হয় না। মাস্ক কিছু বিক্রি হলেও তা আগের তুলনায় ৪০ শতাংশের বেশি নয়। গ্লাভস এখন কেউ কিনছে না।
সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার বিষয়টি নিয়ে মানুষের মাঝে তেমন একটা সচেতনতা কাজ করছে না। একই সঙ্গে এসব সামগ্রী ব্যবহারের সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়ও জড়িত। একমাত্র মাস্ক বাদে অন্য সব সুরক্ষা সামগ্রী অনেক মানুষেরই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এছাড়া অনেক সামগ্রী মাত্র একবারই ব্যবহার করা যায়।
অন্যদিকে মহানগরীর ফার্মগেট এলাকার ভ্রাম্যমাণ দোকানের হকার আজাদুল জানান, যে মাস্ক কিছুদিন আগেও ৫০-৭০ টাকায় বিক্রি হতো, সে মাস্ক এখন ৩ থেকে ৫ টাকায় বিক্রি হলেও ক্রেতারা নিচ্ছে না। শুরুতে মানুষ এসব মাস্কই বেশি দামে কিনেছিল।