একক ব্যক্তি বা গ্রুপ একটি ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ কী পরিমান ঋণ সংগ্রহ করতে পারবে তা একক বৃহত্তম ঋণ সীমা নীতিমালায় নির্ধারিত হলেও একক ব্যক্তি বা গ্রুপ সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাত হতে কি পরিমাণ ঋণ সংগ্রহ করতে পারবে সে বিষয়টি উল্লেখ না থাকার সুযোগে ঋণ গ্রহীতারা বিশেষত ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিরা বিভিন্ন কৌশল ও যোগসাজশের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক হতে ঋণ বের করে নিচ্ছে যার উল্লেখযোগ্য অংশ পরবর্তিতে খেলাপি হয়ে পড়ছে। বর্তমানে ৭ বা ১০ জন শীর্ষ ঋণ গ্রহীতা খেলাপি হলে যথাক্রমে ৩৫ টি এবং ৩৭ টি ব্যাংক মূলধন সংকটে পড়বে।
মঙ্গলবার ‘খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা এবং সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করা হয়।
টিআইবির পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মোহাম্মদ রফিকুল হাসান প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
টিআইবি বলছে, একক বা যৌথভাবে কোনো ব্যাংকের দশ শতাংশের বেশি শেয়ার ক্রয় না করার বিধান থাকলেও বিভিন্ন ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে স্বেচ্ছায় বা রাজনৈতিক প্রভাবে বাধ্য করে নামে-বেনামেকতিপয় ব্যবসায়ী কর্তৃক অধিক শেয়ার ক্রয়ের অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ কর্তৃক ১৪টি প্রতিষ্ঠানের নামে একটি ব্যাংকের ২৮ শতাংশ এবং সাতটি প্রতিষ্ঠানের নামে অপর একটি ব্যাংকের ১৪ শতাংশ শেয়ার ক্রয়। এ বিষয়ে অবগত হওয়া সত্ত্বেও এর মধ্যে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় রদবদল কাজে অনুমোদন দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের গভীর রাত পর্যন্ত অফিসে অবস্থান। এই ব্যবসায়ীর হাতে নয়টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ব্যাংকের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর কতিপয় ব্যবসায়ী-শিল্পগ্রুপ, তাদের নিযুক্ত পরিচালক ও উচ্চ পদস্থ ব্যাংকার, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগকৃত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালক ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, এবং কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করা হয়। জাতীয় সংসদের একটি অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত দেশের ৫৫টি ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা একে অন্যের ব্যাংক থেকে এক লাখ ৭১ হাজার ৬১৬ কোটি ১২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। পরিচালকদের নিজ ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৬১৪ কোটি ৭৭ লাখ ১৭ হাজার টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ। এছাড়া এসকল ব্যাংক পরিচালকের বিরুদ্ধে বেনামেও প্রচুর ঋণ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। এসকল ঋণের বিপুল পরিমাণ অংশ পরবর্তীতে খেলাপি হয়ে যায় এবং প্রভাবের মাধ্যমে এই খেলাপি ঋণে বারবার সুদ মওকুফ, পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন ও অবলোপন ইত্যাদি বাড়তি সুবিধা নেওয়া হয়ে থাকে। এসকল যোগসাজশ বা সিন্ডিকেশনের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর অধিক খেলাপি ঋণের বোঝা তৈরি হয়েছে। উল্লেখ্য ৫০ শতাংশের অধিক খেলাপি ঋণের বোঝা এই ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর রয়েছে। যোগসাজশ থাকার কারণে ঋণ খেলাপি পরিচালকের বিরুদ্ধে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক হতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নোটিশ প্রদান না করায় ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক পদক্ষেপ/ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গেলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা আদালত হতে উক্ত বিষয়ে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসা হয়। এবং অনেক ক্ষেত্রে যোগসাজশে বৃহৎ খেলাপি ঋণ সংক্রান্তমামলা কার্যক্রম দুর্বল করার মাধ্যমে ঋণ খেলাপির অনুকূলে রায় হয়। যেমন, একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া প্রায় ৮০০০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৫০০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ-যা একাধিকবার পুনর্গঠিত হয় এবং পরবর্তীতে আবার খেলাপি হলেও তিনি কখনও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হন না।
এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিচালনায় এ খাত-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করাসহ ১০ দফা সুপারিশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।